বাড়িতে মেয়ের লাশ রেখে বাবাকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ছুটলো হাসপাতালে


 ছোট ভাই বশিরের জন্য বড়ভাই মনির হোসেন অপেক্ষা করছিলেন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটের পাঁচতলায়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন তার শরীরের ছয় শতাংশ পুড়ে গেছে। বশির হোসেন বেঁচে ফিরতে পারলেও তার ১১ বছরের মেয়ে তাহা মারা গেছে।

ইন্সটিটিউট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে বরগুনাগামী অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ২২ জন দগ্ধ ভর্তি হয়েছিল। এদের মধ্যে ১৪ জন পুরুষ, ৮ জন নারী। একজন মারা গেছেন। পাঁচজন চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরেছেন। ভর্তি আছেন ১৫ জন। এর মধ্যে আইসিইউতে ৩ জন, এইচডিইউতে ২ জন এবং পোস্ট অপারেটিভে আছেন ১০ জন। ২২ জনের মধ্যে ঢামেক হাসপাতালে একজন চিকিৎসাধীন।

বরগুনার মনির হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, তার বাসা ঢাকার মধ্য বাড্ডায়। শ্বশুরকে ডাক্তার দেখাতে এসেছিলেন ভাই বশির। সঙ্গে বেড়াতে এসেছিল মেয়ে তাহা। সেদিন বাড়ি ফিরতে চড়েছিলেন অভিযান-১০ লঞ্চে। কিন্তু ১১ বছরের উচ্ছ্বল তাহা ফিরেছে লাশ হয়ে আর বশির এসেছেন হাসপাতালে। সঙ্গে ছিলেন বশিরের শ্বশুরও। আগুন দেখার পর নদীতে লাফ দিয়ে বেঁচে যান তিনি।

মনির হোসেন বলেন, ভাইয়ের দেখা পেতে রাত দুটা থেকে হাসপাতালে আছেন তিনি। এরপর ভাইকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স আসে সকালের দিকে। দেখে চিনতে কষ্ট হচ্ছিল। বললেন, ‘ভাইটার পা নাই, পায়ের তলা নাই, নখ নাই, হাতের চামড়া নাই। একেবারেই অচল হয়ে গেলো। কিছুটা কথা বলতে পারছিলেন বশির। তিনি মনিরকে জানিয়েছেন, ‘ঘুমায়ে ছিলাম। আগুন এমনভাবে লাগলো... দেখলাম পুরা লঞ্চে আগুন দৌড়াচ্ছে। লঞ্চে রঙ করা ছিল। সেই রঙের লাইন ধরেই আগুন ছড়িয়ে গেছে।

মনির হোসেন মনে করেন, শীতে মানুষ গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিল। কম্বল ছিল, শীতের কাপড় ছিল। এগুলো আগুন ছড়িয়েছে বেশি।

মনির হোসেন আরও বলেন, বশির তাকে জানিয়েছে, প্রথমে তাহার শরীরে আগুন লেগে যায়। তার পরনে ছিল জ্যাকেট। সেই জ্যাকেটে আগুন। সেটা খুলতে গিয়ে বশিরের হাতে আগুন লাগে। লঞ্চের ফ্লোরও ছিল গরম।

‘তার পায়ের চামড়া সব ফ্লোরেই রয়ে গেছে।’বললেন মনির।

কিন্তু আগুন তখন বাড়ছে। উপায় না দেশে বশীর মেয়েকে তিনতলা থেকে নদীতে ফেলে নিজেও ঝাঁপ দেন। কিন্তু তাহাকে ধরার আগেই সে তলিয়ে যায় নদীতে।

মেয়েকে খুঁজতে থাকেন বশির। চলে যায় অনেকটা সময়। এরপর খুঁজে পান। এক হাতে আঁকড়ে ধরে পোড়া শরীরে সাঁতরাতে থাকেন।

মনির হোসেন বলেন, এক হাতে তাহাকে ধরে কোনোরকম সাঁতরে পাড়ে আসে বশির। পানিতে তীব্র স্রোত। সাঁতারও কাটতে পারেননি ঠিকমতো।

‘মেয়েটা তখনও বেঁচে ছিল। মেডিক্যালে ভর্তি করতে যাবে, তখনই মরে গেলো। বশিরের দুই সন্তান, তাহা বড়, ছোটটি ছেলে। মেয়ের শোকে এখন অনবরত কাঁদছেন বশির।’

ভাইয়ের সঙ্গে লঞ্চে ওঠার পরও কথা হয়েছে জানিয়ে মনির হোসেন বলেন, লঞ্চে উঠেই বশির বলেছিল, লঞ্চে উঠেছি। কিন্তু ভোর রাতে হঠাৎ আমার খারাপ লাগতে থাকে। ভাইকে ফোন দেই। তখন দেখি ফোন বন্ধ। তখনই মনে কেমন জানি লাগতে থাকে।

সকালে উঠে শুনি বরগুনার লঞ্চ পুড়ে গেছে। আবার ফোন করি, ফোনতো আর যায় না।

পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডের সামনে মনিরের মতো আরও অনেকের আহাজারিতে বাতাস ভারী। কাউকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই কারও। গল্প সবারই এক। কারও স্বজন দগ্ধ হয়ে কাতরাচ্ছে, কেউ হারিয়েছেন স্বজনকে। 

ধাতস্থ হয়ে মনির বলেন, ‘গ্রামে খবর দিই। ততক্ষণে অ্যাম্বুলেন্সে বশির আর তাহাকে ওঠানো হয়েছে। যে অ্যাম্বুলেন্স তাহার লাশ বরগুনার বাড়িতে রেখে আসে, সেই অ্যাম্বুলেন্সই বশিরকে নিয়ে ছুটে আসে ঢাকায়।’

Post a Comment

0 Comments