ব্যাটারিচালিত তিন চাকার রিকশা। |
টাঙ্গাইলে যানজট নিরসন ও দুর্ঘটনারোধ করতে ব্যাটারিচালিত তিন চাকার অবৈধ রিকশা বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশ থাকায় সম্প্রতি পৌর কর্তৃপক্ষ তা বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়।
এরপর সেই রিকশাগুলো আটক করে টাঙ্গাইল স্টেডিয়ামে রাখা হয়।
পরে ধীরে ধীরে আটক করা রিকশাগুলো ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর আবার রিকশাগুলো আটকের উদ্যোগ নেয় পৌর কর্তৃপক্ষ।
রিকশাগুলো আটক করে পৌর উদ্যানে নেওয়া হয়। আর এসব অবৈধ রিকশা লাইসেন্সের মাধ্যমে ‘বৈধ' করা হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয় পৌরসভার পক্ষ থেকে।
এরপর থেকেই শুরু হয় সেই অবৈধ রিকশা বৈধকরণ প্রক্রিয়া। কিন্তু দুই হাজার লাইসেন্সের মধ্যে বেশিরভাগই ভাগাভাগি করে দেওয়া হয়েছে কাউন্সিলর, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির মাঝে। আর লাইসেন্স প্রতি নেওয়া হচ্ছে ২০/২৫ হাজার টাকা। এ নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন হাজার হাজার রিকশাচালকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সম্প্রতি পৌর কর্তৃপক্ষ স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় অবৈধ রিকশাগুলো আটক করে স্টেডিয়ামে নিয়ে ডাম্পিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরে রিকশাচালকরা লাইসেন্স করবেন এমন আশ্বাস দেওয়ার পর সেগুলো ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর চালকদের কাছ থেকে কোনো সাড়া না পাওয়ায় আবার আটকের উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং রিকশাগুলো আটক করে পৌর উদ্যানে নিয়ে একটি করে স্লিপ ধরিয়ে দেওয়া হয় চালকদের। এখন সেই অবৈধ রিকশাগুলো ২০/২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে বৈধকরণের লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে টাঙ্গাইল পৌরসভা থেকে।
আর এই লাইসেন্সগুলো রিকশাচালকরা সরাসরি পৌরসভা থেকে না পাওয়ায় চরম বেকায়দায় পড়েছেন। তাই তারা দালালদের মাধ্যমে এই মোটা অংকের টাকা দিয়েই লাইসেন্স করতে বাধ্য হচ্ছেন।
কাকুয়া ইউনিয়নের সেকান্দার হোসেন নামের এক রিকশাচালক জানান, চার বছর ধরে তিনি রিকশা চালিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। স্থানীয় একটি এনজিও থেকে ৪৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে রিকশাটি কিনেছিলেন। কিন্তু এখন সেই ৪৫ হাজার টাকার রিকশার জন্য ২০ হাজার টাকা লাগবে লাইসেন্স নিতে। এত টাকা কোথায় পাবেন এই ভেবেই তিনি দিশেহারা।
ভাল্লুককান্দি গ্রামের আবুল মিয়া জানান, তিনি দুই বছর আগে এনজিও থেকে ৩৫ হাজার টাকা ঋণ এবং কিছু জমানো টাকায় ৫২ হাজার টাকা দিয়ে রিকশা কিনেছেন। এখন সেই রিকশা পৌরসভা থেকে লাইসেন্স করতে ২০/২৫ হাজার লাগছে। আর যারা ওই টাকায় লাইসেন্স নিয়েছেন তাদের সেগুলো এখনো লাগানোর অনুমতি দেওয়া হয়নি।
এদিকে পৌরসভা থেকে ১৮ পুরুষ ও ছয়জন নারী কাউন্সিলর রয়েছেন। এদের প্রত্যেককেই ১৫টি করে এবং বাকিগুলো বিভিন্ন জনের নামে লাইসেন্সগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আর এসব লাইসেন্স কেউ ভাড়া দিচ্ছেন আবার কেউ ২০/২৫ হাজার টাকা বিক্রি করছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পৌরসভার একজন কর্মকর্তা জানান, শহরে প্রায় ৮ হাজার অবৈধ রিকশা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে দুই হাজার অবৈধ রিকশার লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পৌরকর্তৃপক্ষ। আর এসব লাইসেন্স দালালদের মাধ্যমেই দেওয়া হচ্ছে। পৌরসভায় আর কোন লাইসন্স নেই। এজন্য অনেকে ঘুরে যাচ্ছেন লাইসেন্স না পেয়েছে। আর প্রতিটি লাইসেন্সের প্রকৃত মূল্য ১২০০ টাকা। আর এ টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে জমা দিতে হয়। কিন্তু দালালরা সেগুলো মোটা অংকের টাকায় দরিদ্র রিকশাচালকদের কাছে বিক্রি বা ভাড়া দিচ্ছেন।
কুদ্দুস মিয়া, আলিম ও মুনু মিয়াসহ কয়েকজন রিকশাচালক জানান, তারা সবাই গিয়েছিলেন লাইসেন্স নিতে কিন্তু পৌরসভা থেকে তাদের জানিয়ে দেওয়া হয় লাইসেন্স শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু শুনেছেন কাউন্সিলরসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ১৫/২০টি করে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। তাই যদি হয়, তাহলে তাদেরই রিকশা চালানো উচিত।
সাত্তার মিয়া নামের আরেক রিকশাচালক জানান, তিনি ঋণ নিয়ে ৭০ হাজার টাকা দিয়ে রিকশা কিনেছেন। এখন সেই রিকশা শহরে চালাতে হলে লাইসেন্স করতে হবে। তাই তিনি পৌরসভায় গিয়েছিলেন লাইসেন্স নিতে। কিন্তু তাকে জানানো হয়েছে লাইসেন্স নেই। বাধ্য হয়ে এক কাউন্সিলরের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাকে কাউন্সিলর জানিয়েছেন লাইসেন্স এখন নিতে হলে ৩০ হাজার টাকা লাগবে। তিনি ২২ হাজার টাকা দিতে চেয়েছেন কিন্তু কাজ হয়নি।
রিকশাচালক পরিচয়ে কথা হয় দুই নারী ও দুই পুরুষ কাউন্সিলরে সঙ্গে। এসময় তারা লাইসেন্স বিক্রির কথা স্বীকার করেছেন।
১০, ১১ ও ১২ নম্বর ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলর সেলিনা আক্তার জানান, তিনি কয়েকটি লাইসেন্স পেয়েছেন, তার মধ্যে ২০ হাজার টাকা করে বিক্রি করেছেন কয়েকটি। এছাড়া অন্য কাউন্সিলরা ২৫/৩০ হাজার টাকায়ও বিক্রি করছেন।
১, ২ এবং ৩ নম্বর ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলর মাহমুদা বেগম জেবু জানান, তিনি ৫/৬টি লাইসেন্স ২৫ হাজার টাকা করে বিক্রি করেছেন। বর্তমানে তার কাছে আরও দুই/তিনটি লাইসেন্স আছে। সেগুলো ওই দামেই বিক্রি করতে চান।
দুই নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. রুবেল মিয়া জানান, তিনি টাঙ্গাইলের বাইরে থাকায় তার জন্য যে লাইসেন্স বরাদ্দ ছিল সেগুলো বিক্রি করা হয়েছে। তবে মেয়র সাহেব তাকে জানিয়েছেন তার লাইসেন্স বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এজন্য তোমাকে টাকা দেওয়া হবে। তবে তিনি (রুবেল মিয়া) ঈদের পরে লাইসেন্স পাওয়ার জন্য যোগাযোগ করতে বলেন।
১৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কামরুল হাসান মামুনের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, বর্তমানে তার কাছে কোনো লাইসেন্স নেই। আগামীকাল দুপুর ১২টায় যোগাযোগ করেন। দেখি ব্যবস্থা করতে পারি কিনা।
এ বিষয়ে টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র এস এম সিরাজুল হক আলমগীর বাংলানিউজকে জানান, শুধু পায়ে প্যাডেল করা এক হাজার রিকশার লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। আর প্রতি লাইসেন্স ১২০০ টাকা। কিন্তু যদি কেউ এই লাইসেন্স ব্যাটারিচালিত রিকশায় লাগায় তাহলে তার দায়ভার তাকেই নিতে হবে। তবে তার পৌরসভার কেউ যদি ২০/২৫ হাজার টাকায় লাইসেন্স বিক্রি করে থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
0 Comments