গাছের ডালে থোকায় থোকায় ঝুলছে বড় বড় কমলা। কমলার ভারে নুয়ে পড়েছে গাছের ডালপালা। এ যেন এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। এমন অপরূপ দৃশ্য দেখতে শীত উপেক্ষা করে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার মানুষ আসছেন ৩ বিঘা জমির কমলার বাগান ‘অরেঞ্জ ভ্যালি’তে। এতে দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখোরিত হয়ে উঠছে বাগানটি।বাগানটি দেখে অভিভূত ও অনুপ্রাণিত হচ্ছেন অনেক মানুষ। অর্গানিক পদ্ধতিতে উৎপাদিত হয় এই বাগান কমলা। স্বাদে ও গন্ধে অতুলনীয় হওয়াতে এখানকার উৎপাদিত কমলা বাজারে নিতে হয় না। প্রচুর চাহিদার কারণে বাগানেই বিক্রি হয় ৩০০ টাকা কেজি দরে। এবার ২৫ লক্ষাধিক টাকার কমলা বিক্রি হবে বলে আশা রয়েছে এই উদ্যোক্তার। এই কমলা চাষে একদিকে যেমন পুষ্টি ও ভিটামিনের চাহিদা পূরণ হচ্ছে তেমনি বাগন রক্ষণাবেক্ষণে জন্য ২৫ জনের হয়েছে কর্মসংস্থান।
‘অরেঞ্জ ভ্যালী’ বাগানটি করেছেন উদ্যোক্তা আবু জাহিদ মো. ইবনুল ইকরাম জুয়েল। তিনি ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার বিরহলী গ্রামের বাসিন্দা। গত ১১ বছর আগে ২ নম্বর কোষারাণীগঞ্জ ইউনিয়নের মালঞ্চা গ্রামে ৩ বিঘা জমির ওপরে ভারতীয় দার্জিলিং জাতের কমলার এই বাগান করেন তিনি। বাগানটিতে রয়েছে আড়াইশ গাছ। অষ্টমবারের মতো এবারও চলতি মৌসুমে গত ১ ডিসেম্বর শুরু করেছে গাছ থেকে কমলা সংগ্রহ করা। ১১ বছর আগে চারাগুলো জেলা হর্টিকালচার থেকে প্রতি চারা ৫ টাকা করে ক্রয় করেছিলেন তিনি। গত মৌসুমে এই আড়াইশ গাছ থেকে ১৫ লক্ষাধিক টাকার কমলা বিক্রয় করছেন তিনি।
বাগান দেখতে এসে দুর্নীতি দমন কমিশনের রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মো. আব্দুল করিম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘অফিসিয়াল কাজে ঠাকুরগাঁওয়ে এসেছিলাম। অনেকে কাছে পীরগঞ্জে কমলার বাগানের কথা শুনেছি। তাই যাওয়ার পথে বাগানে এলাম। দেশের মধ্যে এমন সফল বাগান করেছেন। এখানকার মতো যেন আরও অনেকে এমন বাগান করতে পারেন এই প্রত্যাশা করছি।’
দিনাজপুর চিনির বন্দর থেকে আগত দর্শনার্থী সিরাজুল মনি শুভ নামে এক যুবক বলেন, ‘আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে এসেছি বাগানটি দেখেতে। দেখে খুব অভিভূত হলাম। আমাদের দেশে এমন কমলা হতে পারে ভাবাই যায় না। বাগানটি দেখে আমরাও কয়েজ মিলে এমন বাগান করার উদ্যোগ নিয়েছি। এখান থেকেই কমলা গাছের চারা নিয়ে যাবো আমরা।’
বাগান দেখতে এসছিলেন ঠাকুরগাঁও চেম্বার অব কমার্সের সাবেক পরিচালক ও জেলা যুবলীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক এস এম শাওন চৌধুরী। বাগান সম্পর্কে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি দার্জিলিং এ গিয়ে কমলা খেয়েছি আর আজকে এখানকার কমলা খেলাম। এখানকার কমলা ও দার্জিলিং এর কমলা স্বাদে গুণে একই। ঠাকুরগাঁয়ে কমলা চাষে সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভবনাকে কাজে লাগাতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে জেলার প্রতিটি উপজেলায় এমন বাগন গড়ে উঠবে।’
অরেঞ্জ ভ্যালির স্বত্বাধিকারী আবু জাহিদ মো. ইবনুল ইকরাম জুয়েল ঢাকা মেইলকে বলেন, দার্জিলিং অরেঞ্জ কাল্টিভিশন অ্যান্ড টুরিজম করার লক্ষ্যে এই বাগান করা। অর্গানিক পদ্ধতিতে এ বাগান করেছি। এখানে কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। গত মৌসুমে আড়াইশ গাছে ৩শ মণ কমলা ১৫ লাখ টাকা বিক্রয় করেছি। এবার আশা করছি ২৫ লক্ষাধিক টাকার কমলা বিক্রয় করতে পারবো।’
কমলা-মালটা খুব সহজ ও স্বল্প খরচে চাষ করা যায় জানিয়ে এই উদ্যোক্তা বলেন, ১১ বছর আগে জেলা হর্টিকালচার থেকে প্রতি চারা ৫ টাকা দরে ৩০০ চারা ১৫০০ টাকায় ক্রয় করেছিলাম। তাতে সবমিলে তিন বিঘার এই বাগানে চার লক্ষ টাকা খরচ হয়। বর্তমানে আরও দুই বিঘা জমিতে নতুন করে কমলার চাষ শুরু করেছি এবং দুই বিঘা জমিতে মালটার ২০০ গাছ রোপণ করেছি। আশা করছি, আগামী বছরে এই মালটা বাজার জাত করতে পারবো। এসব কমলা ও মালটা চাষ খুব সহজ ও স্বল্প খরচে চাষ করা যায়।’
বাগানে কর্মরত শ্রমিক সুজন আলী ও সৌম দেব শর্মা বলেন, বাগানে প্রায় আমরা ২০-২৫ জন কাজ করছি। এতে যা বেতন পাই, তাতে আমাদের সংসার ভালই চলে। আর এখানে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ আসেন। এতে বাগানের কমলা আমাদের বাইরে নিয়ে গিয়ে বিক্রয় করতে হয় না। এখানে যারা আসেন তাদের চাহিদা অনুযায়ী কমলা দিতে পারছি না এবার। এছাড়াও আমরা এখানে শীতে কাপড়, আচার ও কমলা গাছের চারা বিক্রয় করছি।
কমলা একটি অর্থকারি ফল। এই ফলে চাষ সম্প্রসারণে সার্বিক সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন উপজেলা কৃষি বিভাগের অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা লাইলা আঞ্জুমান বেগম।
জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. মাহবুবুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘জুয়েলের বাগানটি দেশের একমাত্র দার্জিলিং জাতের কমলার বাগান। এটি ইতোমধ্যে মানুষের কাছে পরিচিতি পয়েছে অনেক। এখানে শীত মৌসুমে অনেক দূর-দূরান্ত থেকে কমলা কিনতে ও খেতে আসছেন। তাই এটিকে কেন্দ্র করে পর্যটনেরও সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করছি। জেলা প্রশাসন তার পাশে আছে ও থাকবে। এছাড়াও অন্যরাও জুয়েল সাহেবর কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে এমন কাজে লাগাতে পারেন।’
0 Comments