মোঃ আব্দুল্লাহ আল মনির আশুলিয়া প্রতিনিধি
‘ভাই কই যাইবেন? আশুলিয়া, জিরাবো, জামগড়া... ও আপা কই যাইবেন? নরসিংহপুর, নবীনগর, বাইপাইল’—মুক্তি রানী লেগুনাচালকের আসনে বসেই যাত্রীদের এভাবে ডাকতে থাকেন। কোনো কোনো যাত্রী নারী চালককে দেখে খানিকটা থমকে যান। আবার কেউ কেউ সরাসরি জানতে চান তিনিই লেগুনা চালাবেন কি না।
তবে নিয়মিত চলাচল করা যাত্রীরা দৃঢ় কণ্ঠেই বললেন, এই দিদি গাড়ি খুব ভালো চালান। ব্যস্ত সড়কে দক্ষ চালক না হলে তো গাড়ি চালাতে পারতেন না।
চালকের আসনে বসা মুক্তি রানীর গলায় ঝুলছে লেমিনেটিং করা ড্রাইভিং লাইসেন্স। বললেন, ‘যাত্রী খুঁইজ্যা আনা, যাত্রীর কাছ থেইক্যা ভাড়া তোলা সব আমিই করি।’
প্রায় এক বছর ধরে সাভারের আশুলিয়া এলাকায় লেগুনা চালাচ্ছেন মুক্তি রানী। এর আগে গাড়ি চালানো ও লাইসেন্স পেতে লেগেছে দুই বছর। দিনে যাত্রীভেদে কোনো দিন ৫০০ টাকা আবার কখনো আরও কম বা বেশি টাকা নিয়ে ঘরে ফেরেন তিনি।
টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের প্রত্যন্ত গ্রামে দরিদ্র পরিবারে জন্ম হওয়ায় স্কুলে গেলেও এসএসসি পর্যন্তও পড়তে পারেননি মুক্তি রানী। অভাবের কারণেই তাঁর বাবা সাভারে চলে এসেছিলেন। মাত্র ১২ বা ১৩ বছর বয়সে পোশাকশিল্প কারখানায় কাজ শুরু করেছিলেন, বয়স কম বলে কারখানায় বিদেশি ক্রেতারা এলে মুক্তি রানীকে লুকিয়ে রাখা হতো। কাজ করে দক্ষতাও অর্জন করেছিলেন একসময়।
কিন্তু মুক্তি রানী বললেন, পোশাকশিল্পের কাজে গালাগালি শুনতেই হতো। পরিশ্রমও ছিল। এখন গালিগালাজের বালাই নেই। মন চাইলে লেগুনা নিয়ে বের হন, মন না চাইলে বের হন না।
সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মুক্তি রানী সংসারের কাজ শেষ করে গাড়ি চালানোর ফাঁকে ফাঁকে তাঁর জীবনের গল্প শোনালেন। বললেন, এমনও অনেক দিন থাকে যখন লেগুনার ১০ থেকে ১২ জন যাত্রীর সবাই পুরুষ, আর চালকের আসনে তিনি একা নারী। বললেন, গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার পর থেকে তাঁর মাথায় থাকে যাত্রী, নিজের আর লেগুনার নিরাপত্তার কথা। মুক্তি রানী বললেন, ‘যাত্রীরে গাড়িতে উঠাইছি, নিরাপদে নামাইতে পারি তার চেষ্টা করি সব সময়। নিজের জানের কথাও ভাবতে হয়।’
মুক্তি রানীর সংসার
মুক্তি রানীর স্বামী তপন চন্দ্র বিশ্বাস আশুলিয়ায় একটি পোশাকশিল্প কারখানায় কাজ করেন। আশুলিয়ার উত্তর গাজীরচট (তালতলা) এলাকায় এক কক্ষের বাসায় থাকেন এই দম্পতি। এক ছেলে পড়ছে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। আর ছয় বছর বয়সী মেয়ে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। গাড়ি চালানোর জন্য মুক্তি রানী ভোরে বের হন। ছেলেমেয়েদের দাদার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। ওখানেই বড় হচ্ছে ওরা। ছেলেমেয়েদের খরচ হিসেবে মাসে দুই থেকে তিন হাজার টাকা পাঠান। মাঝেমধ্যে গিয়ে ছেলেমেয়েদের দেখে আসেন অথবা ছেলেমেয়েরা এসে দুই–এক দিন থাকে মা–বাবার সঙ্গে। ব্যস্ত মহাসড়কে গাড়ি চালানোর সময় মুক্তি রানীর চোখেমুখে কঠোর একটি ভাব থাকলেও ছেলেমেয়েদের কথা বলার সময় এ মায়ের দুই চোখ ছলছল করতে থাকে। বললেন, ‘ছেলেমেয়েরা দূরে থাকে। মায়ের বুকটা খালি খালি লাগে।’
মুক্তি রানীর ঘরে লেমিনেটিং করে ছেলে আর মেয়ের ছবি ঝুলিয়ে রেখেছেন। সে ছবিও অনেক আগের। একটি ছোট মিনিস্টার স্মার্ট টেলিভিশন, ছোট একটি ফ্রিজ, ক্যাসেট প্লেয়ার, কাপড় রাখার জন্য ওয়ার্ডরোব, ড্রেসিং টেবিলের ওপর একটি সিঁদুরের কৌটা, চিরুনি, ক্লিপ, একটি শেলফে কিছু হাঁড়ি পাতিল—এই নিয়েই বলতে গেলে মুক্তি রানীর সংসার।
ঋণ করে দেড় লাখ টাকায় মুক্তি রানী পুরোনো লেগুনা কিনেছেন। এখন স্বপ্ন দেখছেন নতুন একটি লেগুনা কেনার
মুক্তি রানীর দিন শুরু হয় ভোর চারটা বা পাঁচটার সময়। দিনের রান্না শেষ করে মুখে কিছু দিয়েই বের হন লেগুনা নিয়ে। দুপুরে মাঝেমধ্যে ঘরে ফিরে দুপুরের খাবার খান। লেগুনা চালিয়ে খুব বেশি খিদে লাগলে একটি ছোট কেক আর এক গ্লাস আখের রস খান। মুক্তি রানীর জীবনে বিলাসিতা বলতে গেলে এইটুকুই। বললেন, ‘পুরুষ চালকেরা গাড়ি চালানোর ফাঁকে আড্ডা দেন, চা, সিগারেট বা অন্য কিছু খান। আমি এইগুলা করি না। বাইরে কিছু খাইতে গেলেও মনে হয়, এই টাকা খরচ না হইলে ছেলেমেয়ের জন্য কিছু ভালোমন্দ কিনতে পারব।’ মুক্তি রানীর সাজসজ্জা বলতে সুতির সালোয়ার কামিজ আর ওড়না পরেন। গলায় একটি তুলসীর মালা আর কানে ছোট দুটি দুল। সিঁথিতে সিঁদুর আর কপালে টিপ।
বাবা, স্বামী ও ভাইয়েরা পাশে আছেন
মুক্তি রানীর বাবা যতীন চন্দ্র দাশ প্রথমে রিকশা চালাতেন, পরে অটো চালানো শুরু করেছিলেন। ট্রাকের ধাক্কায় এ অটোতেই তিনি মারা গেছেন দেড় বছর আগে। মারা যাওয়ার আগপর্যন্ত মুক্তি রানীকে গাড়ি চালানোর বিষয়ে সব থেকে বেশি সাহস দিয়েছেন বাবা। মুক্তি রানীর দুই ভাইয়ের মধ্যে এক ভাই বাবার রেখে যাওয়া অটো চালান। আরেক ভাই লেগুনা চালাতেন, এখন ট্রাক চালান। বাবা, ভাই এবং স্বামীর সহযোগিতায় মুক্তি রানীও এখন লেগুনার চালক।
লেগুনা নিয়ে বের হওয়ার আগে রান্নাসহ সংসার সামলাতে হয় মুক্তি রানীর
ট্রাকচালক ভাই সজীব চন্দ্র দাশ নিজে লেগুনা চালানো শিখিয়েছেন মুক্তি রানীকে। এই ভাইও মুক্তি রানীর বাসার কাছেই থাকেন। তাঁর বোন ভালোই লেগুনা চালান বলে তৃপ্তির হাসি দিলেন। বললেন, ‘আপন বোন, ভালোমতো ট্রেনিং দিছি। গাড়ি দিয়া রাস্তায় তো আর এমনি নামতে দিতে পারি না। আমি গাড়ি চালাই, আমি জানি এইটা কতটা কঠিন কাজ। প্রতি সেকেন্ডের দাম আছে। হিসাবে গণ্ডগোল হইলেই তো দুর্ঘটনা ঘটব।’
সজীব বেশ গর্ব করেই বললেন, ‘বাবা গাড়ি চালাইত। দুই ভাই গাড়ি চালাই। বোনও এখন গাড়ি চালায়। বোন যখন গাড়ি চালানো শুরু করল, তখন অনেক কুকথা শুনছে। হাল ছাড়ি নাই। বোনের গাড়িটা ভাঙাচোরা, ম্যানুয়াল গাড়ি চালাইতে অনেক কষ্ট। তাই বোনটার কষ্টটা একটু বেশি হয়।’ জানালেন, মুক্তি রানী তাঁর কাছে ট্রাক চালানোও শেখার চেষ্টা করছেন।
লেগুনা চালাতে বাবা, স্বামী ও ভাইদের কাছ থেকে সমর্থন পেলেও মা সন্ধ্যা রানী দাশ মেয়ের লেগুনা চালানো পছন্দ করেন না। বলে যানিয়েছেন মুক্তি রানি।
0 Comments