বর্তমান সরকারের আমলে ২০০৯ হতে অদ্যাবধি নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির যতগুলো কমিটি গঠন হয়েছে তার মধ্যে গিয়াসউদ্দিন ও গোলাম ফারুক খোকনের নেতৃত্বাধীন কমিটি ছিল আলোচিত। কারণ এ কমিটি নিয়ে সরকার দলের এমপি শামীম ওসমান সবচেয়ে বেশী মন্তব্য করেছেন। অপরদিকে খোকনের বিরুদ্ধে রূপগঞ্জে সেখানকার এমপি ও মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর ছেলে পাপ্পা গাজী হুংকার দিয়েছেন হুশিয়ারীও করেছেন। তাঁর বাড়ির সামনে জায়গা দখল করে যুবলীগের কার্যালয় নির্মিত হয়েছে মর্মে আদালতে মামলাও হয়েছিল। দলের নেতাকর্মীরা বলছেন, বিগত দিনের কমিটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নানাভাবে যোগাযোগ সম্পর্ক ও তল্পিবাহক থাকলেও এখনকার কমিটির সঙ্গে সম্পর্ক পুরোটাই সাউপে নেউলের।
নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির আহবায়ক গিয়াসউদ্দিন ২০০১ সালের ১ অক্টোবর সংসদ নির্বাচনে শামীম ওসমানকে হারিয়ে এমপি হন। পরে ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে গিয়াসের আসনে এমপি নির্বাচনে করে হেরে যান বিএনপির শিল্পপতি শাহআলম। নির্বাচনের পরে টাকার জোর খাটিয়ে দলে প্রভাব বিস্তার শুরু করেন তিনি। মাইনাস করতে থাকেন গিয়াসউদ্দিনকে। ফলে অনেকটাই রাজনৈতিকভাবে কোনঠাসা হন গিয়াস।
২০০৯ সালে তৈমূর আলম খন্দকার সভাপতি, কাজী মনিরুজ্জামান সাধারণ সম্পাদক ও শাহআলম হন সহ সভাপতি। পরবর্তীতে কাজী মনির সভাপতি ও অধ্যাপক মামুন মাহমুদ সেক্রেটারী হয়েছিলেন। পরের কমিটিতে তৈমূর ফের আহবায়ক ও মামুনকে সদস্য সচিব করা হয়। কিন্তু এসব কমিটির বিরুদ্ধে ছিল নানা অভিযোগ। বিশেষ করে কাজী মনির ও মামুনের কমিটির সময়ে থানা কমিটিগুলোতে অযোগ্য নেতৃত্ব প্রদানের অভিযোগ ছিল। তাছাড়া মামুনের বিরুদ্ধে কমিটি বাণিজ্য সহ বিস্তর অভিযোগ আছে। প্রবল অভিযোগের মুখে কাজী মনির ও মামুনের কমিটি বাতিল হওয়ার পর ফের নেতৃত্বে আসে তৈমূর ও মামুন। কিন্তু ২০২২ সালের ১৬ জানুয়ারী নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মেয়র হিসেবে স্বতন্ত্র প্রার্থী পদে লড়াই করে হেরে যাওয়ার পর বিএনপি দল থেকে তৈমূরকে বহিস্কার করেন। তখন ভারপ্রাপ্ত আহবায়ক ছিলেন মনিরুল ইসলাম রবি। তিনিও কারাগারে গেলে আরেক ভারপ্রাপ্ত নাসিরউদ্দিন ও মামুন মিয়ে বেশ কয়েকটি ইউনিট ও থানা কমিটি গঠন করে যেটা নিয়ে চরম বিতর্ক ছিল।
এর মধ্যে গত বছরের ১৫ নভেম্বর জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটি ঘোষণা করা যেখানে গিয়াসউদ্দিনকে আহবায়ক করা হয়। বদলে যায় বিএনপির চিত্র। রাতারাতি পরিবর্তন আসে রাজনৈতিক ধারায়। এর মধ্যে গিয়াসউদ্দিনের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ তুলতে থাকেন শামীম ওসমান। একজন প্রভাবশালী এমপির কণ্ঠে গিয়াস বিদ্বেষ পুরো বিষয়টিকে আলোচনায় করে তুলে। এ অবস্থায় জেলা বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব এবং বতর্মান আহবায়ক কমিটির প্রথম যুগ্ম আহবায়ক মামুন মাহমুদকে ছুরিকাঘাত করার মামলায় ৭ জনের নাম উল্লেখ করে চার্জশীট দাখিল করে পুলিশ। এ চার্জশীটে যাদের আসামি করা হয়েছে সেখানে গিয়াসউদ্দিনের ছেলেসহ তার কয়েকজন অনুসারীর নাম রয়েছে। যা নিয়ে নারায়ণগঞ্জে চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে গত বছরের ২৫ এপ্রিল পল্টনে জেলা বিএনপির বৈঠক শেষে বের হবার পর কস্তুরি রেস্টুরেন্টের সামনে মামুন মাহমুদকে ছুরিকাঘাত করা হয়। এ ঘটনায় মামুন মাহমুদের স্ত্রী বদরুন্নাহার বাবলী বাদী হয়ে পল্টন থানায় মামলা করেন। শামীম ওসমান এ মামলা নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। বিষয়টি কেন্দ্রেও নজরে এসেছে যে। তাছাড়া কথায় কথায় মামুনকে ভদ্রলোক ও গিয়াসউদ্দিনকে খুনী আখ্যা দিয়ে চলেছেন শামীম ওসমান। তবে কমিটি গঠনের আগেই মামুন মাহমুদকে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগের সাংসদ শামীম ওসমানের লোক হিসেবে আখ্যা দিয়ে গত বছর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বরাবর আবেদন করেন ফতুল্লা থানা বিএনপির সিনিয়র ১৯ জন নেতা।
মোট কথা গিয়াস ও খোকনের কমিটি আসার পর আওয়ামী লীগের অনেকের গাত্রদাহ শুরু হয়ে যায়। বিপরীতে তাঁরাও আওয়ামী লীগকে ছাড় দিয়ে কথা বলছেন না।
অপরদিকে গিয়াসউদ্দিনের সঙ্গে অভিজ্ঞ রাজনীতিকের সঙ্গে তরুণ নেতা হিসেবে বেশ পরিচিতি লাভ করেন গোলাম ফারুক খোকন। তিনি জেলা যুবদলের সবশেষ কমিটির সদস্য সচিব। দলের পেছনেও রয়েছে নিবেদিত প্রাণ। তরুণ বয়সে রূপগঞ্জে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের পাশাপাশি মুড়পাড়া কলেজের ভিপি হিসেবেও ছিলেন জাদরেল নেতা। যুবদলের অনেক নেতার বিরুদ্ধে যেখানে কমিটি বাণিজ্য কিংবা অর্থনৈতিক লেনদেনের বিষয়টি প্রতীয়মান সেখানে উল্টো দলের জন্য বিশ্বস্ত খোকন। এ খোকন আবার বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান ভূইয়া দিপুর ঘনিষ্ঠজন। দিপুর পক্ষে থাকার কারণে মুড়াপাড়ায় রূপগঞ্জে গোলাম ফারুক খোকনের বাড়ির গেটের বিপরীতে জমিতে যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের কার্যালয় বা স্থাপনা নির্মাণ করতে আদালতের নিষেধাজ্ঞার পরেও সেখানে কাজ চলমান আছে। এ অবস্থায় সেখানে ৩১ জুলাই কার্যালয় উদ্বোধন করে রীতিমত খোকনকে কড়া ভাষায় হুশিয়ারী দিয়েছেন মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর ছেলে গাজী গোলাম মর্তুজা পাপ্পা।
গোলাম ফারুক খোকন বলেন, ২২ মে মুড়াপাড়া ইউনিয়ন বিএনপির সম্মেলনকে কেন্দ্র করে আমার বাড়িতে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা হামলা করে ভাংচুর ও লুটপাট চালায়। এসময় সন্ত্রাসীরা কয়েক রাউন্ড ফাকা গুলিবর্ষণ করে এবং কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। এর পর থেকেই ক্ষমতাসীন দলের লোকজন আমাদের বাড়ির আশেপাশে মহড়া দিচ্ছে। এখন সেখানে তারা যুবলীগের অফিস বানাচ্ছে। ২২ জুন আমাদের লোকজন বাধা দিলে প্রথমে কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে আবার পুলিশের উপস্থিতিতে কাজ শুরু হয়।
এদিকে ৪ আগস্ট বিকাল ৩ টায় উপজেলার ভুলতায় দিপুর অফিস ও তার মালিকানাধীন মার্কেটের বণিক সমিতির অফিসে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর চালিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিএনপির দাবি, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা লীগ ও যুবমহিলা লীগের নেতাকর্মীরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
এর আগে ২০১৫ সালে ভূইয়া দিপুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে রেখেছিল ছাত্রলীগের বাহিনী। সে সময়ে দিপু ভূইয়াকে উদ্ধার করতে গিয়ে মারধর ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতের শিকার হন ছাত্রদলের সালাউদ্দিন, রাকিব সহ আরো কয়েকজন। ওই বছরের ২৮ অক্টোবর দুপুরে গোলাকান্দাইলে দিপুর বাড়িতে আলোচনা সভার আয়োজন করে উপজেলা যুবদল। দুপুর উপজেলা যুবদলের গোলাম ফারুক খোকনের নেতৃত্বে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের গোলাকান্দাইল এলাকায় একটি র্যালী বের করে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ভুলতা, গোলাকান্দাইল, বলাই খাঁ, সাওঘাট এলাকা প্রদক্ষিণ শেষে র্যালিটি কাচারীবাড়িতে এক সংক্ষিপ্ত সভার আয়োজন করলে উপজেলা ছাত্রলীগের ৪০-৪৫জন নেতাকর্মী হামলা চালায়। এক পর্যায়ে পুলিশের সামনেই ছাত্রলীগের লোকজন দিপুর বাড়ির বেস্টনীর ভেতরে প্রবেশ করে লাঠিসোটা নিয়ে একের পর এক গাড়ি ভাঙচুর ও বাড়িতে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। ওই সময়ে দিপু বাইরে এসে নিজের দলের লোকজনদের উদ্ধার করতে আসলে ছাত্রলীগের লোকজন প্রথমে বাধা দেয়। কিন্তু দিপু তার পরেও নেতাকর্মীদের উদ্ধার করতে এলে দুই ক্যাডার দিপুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে হত্যার চেষ্টা করে। তখন তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডাও ঘটে।
বিএনপির একাধিক নেতা বলছেন, গিয়াস ও খোকনের বিরুদ্ধে দলের একটি গ্রুপের অভিযোগ তারা দলকে গতিশীল করেছেন। কারণ সুবিধাভোগীরা এ ধরনের নেতৃত্ব চায়নি। তারা চেয়েছিল এমন তল্পিবাহক নেতৃত্ব যারা নিয়ন্ত্রকদের ইশারায় পকেট কমিটি গঠন ও কমিটি বাণিজ্যকরণ করতো।
0 Comments