দীর্ঘ ৭০ বছর পর মা ও ছেলের দেখা হলো। এই আনন্দময় মুহূর্ত দেখে উপস্থিত কেউ চোখের জল আটকে রাখতে পারেননি। ৮০ বছরের বৃদ্ধ ছেলে আব্দুল কুদ্দুস মুন্সি যখন শতবর্ষী মা আমরো বেওয়ার হাত ধরে পাশে বসলেন, তখন সিনেমার গল্পকেও হার মানানো কিছু একটা ঘটে গেল বলে মনে হলো। আজ শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার আশ্রাববাদ গ্রামের ঝর্না বেগমের বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। ঝর্না কুদ্দুসের বোন।
কুদ্দুস ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার শ্যামগ্রাম সলিমগঞ্জ ইউনিয়নের বাড্ডা গ্রামের মৃত কালু মুন্সীর ছেলে। বয়স যখন ৬-৭ বছর, তখন বাবা মারা যান কুদ্দুসের। বাবার মৃত্যুর পর মা ছেলেকে পড়াশোনার জন্য তাঁর ফুফা পুলিশের দারোগা আব্দুল আওয়ালের কাছে রাজশাহীর বাগমারায় পাঠান। সেখানে ফুফুর বকা খেয়ে অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে নিখোঁজ হন কুদ্দুস। ১০ বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়া সেই ছেলের বয়স এখন ৮০ বছর। ৭০ বছর পর মা, বোন ও আত্মীয়স্বজনকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা কুদ্দুস।
জানা গেছে, বাগমারার বারুইপাড়া গ্রামে বসবাস করেন কুদ্দুস। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় তাঁকে নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার আশ্রাববাদ গ্রামের দিকে রওনা দেন কয়েকজন। আজ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বাঞ্ছারামপুরে পৌঁছান তিনি। কুদ্দুসের ছেলে সোহেল মুন্সী, সোহেলের স্ত্রী, সোহেলের ছেলে-মেয়ে এবং মা-ছেলের পরস্পরকে খুঁজে পেতে সহায়তা করা আইয়ুব আলীসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
ছেলেকে কাছে পেয়ে বৃদ্ধ মা বলেন, ‘আমার বিশ্বাস ছিল, ছেলে ফিরে আসবে।’ কুদ্দুস বলেন, ‘মায়ের কাছে ফিরে আসার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। প্রতীক্ষার দীর্ঘ ৭০ বছর হয়েছে। আজ মায়ের হাত স্পর্শ করলাম, পাশে বসলাম। কতটা প্রশান্তি লাগছে, তা ভাষায় ব্যাখ্যা করতে পারব না। আমি আমার মাকে ফিরে পেয়েছি।’
গত ১২ এপ্রিল আইয়ুব আলী নামে আত্রাইয়ের সিংড়া বাজারের এক দোকানি তাঁর ফেসবুকে কুদ্দুসকে নিয়ে একটি ভিডিও পোস্ট করেন। সেখানে তাঁর বাবা, গ্রাম ও উপজেলার নাম উল্লেখ করে আপনজনদের সন্ধান চাওয়া হয়। একপর্যায়ে তাঁদের সন্ধান মিলে যায়। এরপর কয়েকজন আত্মীয় ২১ সেপ্টেম্বর একটি বেসরকারি টেলিভিশনের প্রতিনিধিকে সঙ্গে নিয়ে বাগমারার বারুইপাড়া গ্রামে আসেন। সেখানে ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়া ছেলে কুদ্দুসকে তাঁরা চিনতে পারেন। তিনিও চিনে ফেলেন তাঁদের কয়েকজনকে।
ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়ার স্মৃতিচারণা করে কুদ্দুস বলেন, একদিন ফুফুর বকুনি খেয়ে তিনি বাড়ি থেকে অজানা গন্তব্যে বেরিয়ে যান। ঘুরতে ঘুরতে চলে যান নওগাঁর আত্রাইয়ের সিংহগ্রামে। সেখানে একজন নারীর আশ্রয়ে ছিলেন বেশ কিছুদিন। এরপর চলে যান ওই এলাকারই দুই বোন সুন্দরী ও কপিজানের আশ্রয়ে। তাঁদের যত্নে বেড়ে উঠে আত্রাইয়ের চৌবাড়ি গ্রামে বিয়ে করেন। সেই সংসারে তিন ছেলে ও চার মেয়ে। এরপর বাগমারার বারুইপাড়া গ্রামে দ্বিতীয় বিয়ে করে সেখানেই থেকে যান তিনি।
আত্রাইয়ের ব্যবসায়ী আইয়ুব আলী প্রথম আলোকে বলেন, তিনি আবদুল কুদ্দুসকে আগে থেকে চিনতেন এবং মামা বলে ডাকতেন। তাঁর জীবনের গল্প জানার পর অনুমতি সাপেক্ষে তাঁকে নিয়ে ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট দেন। পোস্টটি তাঁর আপনজনদের নজরে আসে। মাত্র সাড়ে চার মাসে স্বজনের খোঁজ মেলে। মা-ছেলের দেখা হওয়ার দৃশ্য নিজের চোখে দেখতে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে এসেছেন। কতটা আনন্দিত তিনি, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছেন না বলে জানালেন।
0 Comments