গত শুক্রবার ভোর ৬টা থেকে শনিবার ভোর ৬টা পর্যন্ত ৩৬ ঘণ্টা পরিবহন ধর্মঘট পালন করেছে রংপুর জেলা বাস মালিক সমিতি। মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের কথিত দাবি তুলে এ ধর্মঘট ডাকা হয়। বাস মালিক সমিতির কর্মসূচি সফল হয়েছে কিনা তা জানা না গেলেও বিএনপি যে সফলভাবে কর্মসূচি শেষ করতে পেরেছে তা নিশ্চিত। পরিবহন ধর্মঘট যেন সমাবেশের উপস্থিতি বাড়াতে পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে। সমাবেশ শুরুর ৩৬ ঘণ্টা আগে থেকে সমাবেশস্থলে জড়ো হয়েছেন দলটির নেতাকর্মীরা। স্কুটার, ভটভটি, রিকশা, ইজিবাইক, ভ্যানগাড়ি, মোটরসাইকেল, সাইকেলে চড়ে সমাবেশে যোগ দিয়েছেন তারা। অনেকে আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছেন।
কেউ কেউ পাটি কিংবা পলিথিন নিয়ে এসেছেন মাঠে ঘুমানোর জন্য। কারও সঙ্গে কাঁথা-কম্বল। সঙ্গে ছিল চিঁড়া-মুড়ি আর শুকনো খাবার। শত বাধা আর উদ্বেগের মধ্যেও উৎসব ভাব। এ যেন রাজনীতিতে নতুন এক ট্রেন্ড। বিএনপি নেতারা বলছেন, নেতাকর্মীদের এমন মনোভাব তারা অতীতে লক্ষ্য করেননি। এই মনোভাবকে পুঁজি করে ভবিষ্যতে সরকার পতনের আন্দোলনকে তারা বেগবান করতে পারবেন। রংপুরের স্থানীয়রা জানান, অতীতে বিএনপি কেন কোনো রাজনৈতিক দলের সমাবেশে এত মানুষের উপস্থিতি তারা লক্ষ্য করেননি। বিশেষ করে সমাবেশের দুইদিন আগেই যে নগরীতে বিএনপি নেতাকর্মীদের আনাগোনা বেড়েছিল তা ছিল লক্ষ্যণীয়। গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে নগরীর মোড়ে মোড়ে বিভিন্ন জেলা, উপজেলা কমিটির পক্ষ থেকে সুসজ্জিত তোরণ নির্মাণ করা হয়। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের বিলবোর্ডগুলোতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রচার চালানো অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই সাজগোজের মধ্যে উৎকণ্ঠা ছিল সমাবেশের উপস্থিতি নিয়ে। প্রাথমিকভাবে সমাবেশ করার পরিকল্পনা ছিল রংপুর জিলা স্কুল মাঠে। কিন্তু স্থানীয় ছাত্রলীগের সম্মেলনের অজুহাত দেখিয়ে তা বরাদ্দ দেয়নি প্রশাসন। পরে মৌখিকভাবে কালেক্টরেট ঈদগাহ মাঠ ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়। সেখানেই বিভাগীয় গণসমাবেশের প্রস্তুতি শুরু করে বিএনপি। এরই মধ্যে মহাসড়কে অননুমোদিত যান চলাচল বন্ধের দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দেয় রংপুর জেলা মোটর মালিক সমিতি। ফলে শুধু রংপুর বিভাগ নয়, বগুড়া-রাজশাহী অঞ্চলের সঙ্গে বাস যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। বিকল্প হিসেবে শুক্রবার ট্রেনে করে দূরের জেলাগুলো থেকে নেতকর্মীরা সমাবেশে আসতে শুরু করেন।
যারা ট্রেন ধরতে কিংবা ট্রাক ভাড়া করতে পারেননি তারা ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকে এসেছেন। গণসমাবেশে যোগ দিতে লালমনিরহাটের বড়বাড়ী ও নীলফামারীর সৈয়দপুর থেকে ১২০০ ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, ভ্যান ও রিকশায় করে হাজার হাজার নেতাকর্মী রংপুরে এসেছেন। এরমধ্যে শুধু বড়বাড়ী থেকে ৫ শতাধিকের বেশি ইজিবাইকে করে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে রংপুরের সাতমাথা এলাকায় এসে পৌঁছান দলের নেতাকর্মীরা। আর হাজার হাজার নেতাকর্মীসহ সৈয়দুপুর থেকে প্রায় ৭০০ রিকশা-ভ্যানের একটি বহর আসে। ১০০ কিলো সাইকেল চালিয়ে ঠাঁকুরগাও থেকে ৩০ যুবক সমাবেশে যোগ দেন। ক্রাচে ভর দিয়েও শারীরিকভাবে অক্ষম কয়েকজনকে সমাবেশে যোগ দিতে দেখা গেছে। শনিবার সমাবেশস্থলে জায়গা না হওয়ায় কালেক্টরেট মাঠের আশপাশের পাড়া-মহল্লা ও রাস্তায় মানুষ অবস্থান নেয়। সমাবেশ ছড়িয়ে পড়ে নগরীর একটি বড় অংশ জুড়ে।
সমাবেশ ছড়িয়ে পড়ে জাহাজ কোম্পানি মোড় থেকে মেডিকেল মোড় পর্যন্ত। সমাবেশ মঞ্চ ও মাঠের আশপাশসহ প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ১৩০টি মাইক টাঙানো হয়। তবে অভিযোগ রয়েছে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ মাইক লাগানোর অনুমতি না পাওয়ায় বহু মানুষ নেতাদের বক্তব্য শোনা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বিএনপির নেতাকর্মীদের পাশপাশি বহু সাধারণ মানুষও সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরাও দলে দলে সমাবেশে যোগ দিয়েছেন- এমন খবর ছড়িয়ে পড়ে শনিবার দুপুরে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় পার্টির একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, বিএনপির সমাবেশে যাওয়ার জন্য নেতাকর্মীদের প্রতি কোনো নির্দেশনা ছিলনা। তবে কেউ গিয়ে থাকলে দলের আপত্তি থাকার কথা না।
বতর্মান সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় পার্টিও আন্দোলন করছে। তাই যারা সমাবেশে গিয়েছে তারা সরকারের প্রতি অনাস্থা জানাতেই গিয়েছে বলে মনে করেন তিনি। রংপুর বিভাগীয় গণসমাবেশ বাস্তবায়ন কমিটির সমন্বয়ক এবং দলের সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক উপমন্ত্রী অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু মানবজমিনকে বলেন, এই সমাবেশের মাধ্যমে বিএনপির আন্দোলন তথা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও বিদ্যুতের ভয়াবহ লোডশেডিং-এর প্রতিবাদ এবং দেশনেত্রী বেগম জিয়ার মুুক্তির দাবির সঙ্গে জনগণ একাত্মতা প্রকাশ করেছে। এই সমাবেশ থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বার্তা দিচ্ছে যে, তারা কঠিন আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত। তা না হলে তারা খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতো না, ৩০/৪০ কিলোমিটার হেঁটে সমাবেশস্থলে তারা যোগদান করতো না। রংপুর অঞ্চলের মানুষের এমন সংগ্রামী চেতনাকে ঐতিহাসিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, তার গোটা রাজনৈতিক জীবনে নেতাকর্মীদের মধ্যে এমন তেজোদীপ্ত মনোভাব লক্ষ্য করেননি। শত বাধা-বিঘ্নের মধ্যেও সমাবেশ সফল করতে তারা বদ্ধ-পরিকর ছিল। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে এ সমাবেশ নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে।
0 Comments