মোঃ শহীদুজ্জামান আতিফঃ
২১ ফেব্রুয়ারী। আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ তারিখে প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) এর সাধারণ সম্মেলনে ইউনেস্কো সাধারণ পরিষদের ১৮৮ সদস্যের সর্মথনে সর্বসম্মতি ক্রমে গৃহীত সিদ্ধান্তে ২১ ফেব্রুয়ারী কে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় (প্রস্তাব ৩০ সি/ডি আর ৩৫)। গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়, পৃথিবীতে প্রায় ৫০০ মাতৃভাষা আছে। মাতৃভাষার আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতি ও মর্যাদাদানের জন্য একটি বিশেষ দিবস থাকা প্রয়োজন। ১৯৫২ সালের ফেব্র“য়ারী মাসের ২১ তারিখে বাঙ্গালী চেতনায় উদ্বীপ্ত ছাত্ররা মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়েছিলো। তৎকালীন পাকিস্তানী সরকারের বর্বরতায় ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলি বর্ষণে নিহত হয় অনেক নাম না জানা ছাত্র। নিহত ছাত্রদের লাশও তাৎক্ষণিক ভাবে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। পরে অবশ্য বিভিন্ন চাপের মুখে পাকিস্তানী সরকার ৪ জন ছাত্রের নিহত হওয়ার কথা স্বীকার করে। বাঙ্গালী জাতির ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারী ছাত্রদের জীবন বিসর্জনের এই দিনটি আর্ন্তজাতিক ভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত হতে পারে, এমন ধারণার প্রথম উৎপত্তি ঘটে কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশীদের মনে। তারাই “মাদার ল্যাংগুয়েজ মুভমেন্ট” ভিত্তিক একটি সংগঠনের সহায়তায় এই ঐতিহাসিক ও অনন্য সাধারণ প্রকৃয়াটির সূচনা করেছিলেন। ১৯৯৮ সালের জানুয়ারিতে তারা ২১ ফেব্র“য়ারী কে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার যৌতিকতা তুলে ধরে প্যারিস দুতাবাসের মাধ্যমে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে আবেদন করেন। মহাসচিব তাদের বিষয়টি ইউনেস্কোর নিকট উত্থাপনের পরামর্শ প্রদান করেন। সেই পরামর্শ অনুযায়ী তারা ইউনেস্কোর কাছে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস সম্পর্কিত একটি আবেদন পত্র পেশ করেন। কিন্তু কোন বেসরকারি সংগঠনের এই ধরণের আবেদন বিবেচনা করতে ইউনেস্কো রাজি হয়নি। তাদের উপদেশ হলো, এই দাবিটি-ই যদি কোন রাষ্ট্র থেকে করা হয় তাহলে সেটি বিবেচনা করে দেখা হবে। পরবর্ত্তীতে প্রবাসী বাংলাদেশীদের পরামর্শে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিক ভাবে ইউনেস্কোর কাছে ২১ ফেব্র“য়ারীকে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করার জন্য প্রস্তাব পাঁঠায়। ইউনেস্কো আয়োজিত এক সম্মেলনে পৃথিবীর ১৮৮টি দেশ বাংলাদেশের এই প্রস্তাবকে সর্মথন করে। অতঃপর সর্ব সম্মতিক্রমে তা অনুমোদিত হয়।
পৃথিবীর মাতৃভাষা গুলোর মধ্যে বাংলা ভাষাই সম্ভবত একমাত্র ব্যতিক্রম যে, এই ভাষাটিতে তাঁর প্রাচীন রূপ থেকেই মর্যাদা ও অধিকারের প্রশ্নে লড়াই করে আসতে হয়েছে। বাংলার আদিকালে ‘সেন’ শাসন আমলে বাংলা ভাষার চর্চার বিরূদ্ধে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা জারি করে বলা হয়েছিলো বাংলা ভাষা চর্চা করলে রৌরব নামক নরকে যেতে হবে। মধ্যযুগে এসেও বাংলা ভাষার বিরূদ্ধে অবহেলা থেমে থাকেনি। বৃটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত বাংলা ভাষার বিরূদ্ধে ছিলো নানাবিধ ষড়যন্ত্র। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পূর্ব থেকেই বাংলা ভাষাকে দাঁড় করানো হয়েছিলো প্রতিপক্ষ হিসেবে। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হয় মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে বাঙ্গালী জাতির প্রত্যক্ষ সংগ্রাম। পাকিস্তান সরকারের নানা রকম চক্রান্ত, আঘাত ও অশুভ পদক্ষেপের কারণে আন্দোলন ক্রমান্বয়ে আরো বিস্তার লাভ করতে থাকে। আন্দোলনের চুড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারী আন্দোলনরত জনতার উপর পুলিশের গুলিতে নিহত হয় রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত সহ আরো অনেকে। গুরুতর আহত হয় অসংখ্য ছাত্র ও ছাত্র নেতা। এর থেকে সৃষ্টি হয় মাতৃভাষার জন্য আত্মত্যাগের মহান ও অভূতপূর্ব ইতিহাস। মহান আত্মত্যাগের এই দিনটিকে বাঙ্গালী জাতি পালন করে আসছিলো জাতীয় শহীদ দিবস হিসেবে। বাংলাদেশ ও সমগ্র বাঙ্গালী জাতির ইতিহসে অমর একুশে ফেব্র“য়ারী একটি অতি গুরুত্ত্বপূর্ণ দিন। এই ঘটনার হাত ধরে বাঙ্গালী জাতি পেয়েছে স্বাধীনতার চেতনা। খুঁজে পেয়েছে নিজস্ব একটি মানচিত্র। প্রতিষ্ঠা করেছে স্বাধীন বাংলাদেশ। ২১ ফেব্র“য়ারীকে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার মাধ্যমে এই স্বাধীনতার ইতিহাস যুক্ত হলো বিশ্ব ইতিহাসে। সকল জনগোষ্ঠীর জগৎসভায় বাঙ্গালীর মাতৃভাষা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস সমাদৃত হবে সম মর্যাদায়।
ফেব্রুয়ারী মাস আমাদের জন্য গর্বের এবং অহংকার ও একই সাথে আবেগের মাস। “একুশে ফেব্র“য়ারী” শব্দ দু’টি একত্রে উচ্চারিত হলেই প্রতিটি বাঙ্গালীর স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে এক চিরন্তন চিত্রকল্প। হৃদয়ে বেজে ওঠে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্র“য়ারী,আমি কি ভূলিতে পারি…?’ একুশে ফেব্র“য়ারীর প্রথম প্রহর থেকেই শুরু হয় ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধার্ঘ ও পুষ্পস্তবক অপর্ণ। নামে সর্বস্তরের জনতার ঢল। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটির বর্তমান রূপ ধারণ করতে সময় লেগেছে দীর্ঘ ৩১ বছর। জানা গেছে, বর্তমান শহীদ মিনারের দক্ষিণ-পূর্ব কোনায় শহীদদের রক্ত চিহ্নের স্থানে ১০ ফুট * ৬ ফুট ভিত্তির ওপর একটি ছোট স্থাপত্য নির্মিত হয়েছিলো। ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রৃয়ারী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোষ্টেল প্রাঙ্গনে নির্মিত অস্থায়ী শহীদ মিনারটি ২৪ ফেব্র“য়ারী শহীদ শফিউরের মা উদ্ধোধন করেন। ১৯৫৩ সাল থেকে ২১ ফেব্র“য়ারীকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা শুরু করে যুব সমাজ। ১৯৫৭ সালে শিল্পী হামিদুর রহমানের নকশা ও পরিকল্পনায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাজ শুরু হয়। ১৯৬৩ সালে শহীদ বরকতের মা শহীদ মিনারের আনুষ্ঠানিক উদ্ধোধন করেন। ১৯৮৩ সালে শহীদ মিনারের মূল নকশাকে সম্প্রসারিত করে শহীদ মিনারটিকে পুর্ণনির্মাণ করা হয়। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো সারা বছর ধরে এই শহীদ মিনারের পবিত্রতা বজায় রাখতে এবং এর সার্বিক রক্ষনাবেক্ষনের জন্য সরকারের পক্ষ্য থেকে কোন উদ্যোগ নেয়া হয় না। ডিসিসি এরও এ সংক্রান্ত কোন কর্মপরিকল্পনা থাকে না। ২১ ফেব্রুয়ারী আসার আগে শহীদ মিনারকে ধুয়ে-মুছে, চকচকে-ঝকঝকে করে তোলা হয়। সারা বছর যেখানের পবিত্রতা নষ্ট হয় সেখান থেকে মাত্র কয়েক দিনে চাকচিক্য ফিরিয়ে আনার কাজ এবার হাতে নিয়েছে পিডব্লিউডি। ২৩ জন শ্রমিককে তারা নিয়োজিত করেছে শহীদ মিনার পরিস্কার ও রং করার জন্য। ১৯ তারিখের মধ্যে শ্রমিকদের কাজ শেষ করতে বলা হয়েছে। ২১ ফেব্র“য়ারী চলে যাওয়ার পর সেখানে আবারও প্রতি নিয়ত চলবে নানান অপকর্ম। চলবে প্রেমিক-প্রেমিকাদের অশ্লীল কার্যক্রম। চলবে নেশাখোরদের আড্ডা। কতো সরকার আসে-যায়। কতো কিছু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হয়। কিন্তু এই সকল নোংরা চিত্র গুলোর দিকে কারো নজর যায় না। ২১ ফেব্র“য়ারী ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে আমাদের দেশের তথাকথিত জনসেবকরা শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। পালন করেন সাময়িক নীরবতা। এরপর সব কিছুই চলতে থাকে নিত্যনৈমিত্তিভাবে। একটি জাতির জন্য এর চেয়ে বড় কলঙ্ক আর কি হতে পারে?
ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীতে ৫ লাখ বছর পূর্বে ভাষার জন্ম হয়েছিলো। ২০ শতকের শেষ প্রান্তে এসে ইউনেস্কো মাতৃভাষা গুলোর অধিকার ও মর্যদা প্রতিষ্ঠার অনন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। প্রতি বছর ১৮৮টি দেশে বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস উচ্চারিত হবে। একই সাথে পৃথিবীর বৃহৎ ভাষা গুলোর পাশে ক্ষুদ্র নিপীড়িত ও অবহেলিত ভাষা গুলোও বেঁচে থাকার সুযোগ পবে। তবে বাংলা ভাষা এবং ভাষা শহীদদের ইতিহাস অক্ষুন্ন রাখার দ্বায়িত্ব সমগ্র বাঙ্গালী জাতির। এ বিষয়টি সম্পর্কে সকলের আরো সুদৃঢ় মনোবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ আবশ্যক…!
0 Comments